Air Pollution
|

বায়ু দূষণের ১০টি কারণ

আমরা সবাই জানি, বাতাস আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। শ্বাস নেওয়ার সময় বিশুদ্ধ বাতাস না থাকলে আমাদের শরীরের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বায়ু দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে তো বায়ুর অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই দূষিত বাতাস গ্রহণ করছে, যার ফলে নানা রকম শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে।

বায়ু দূষণ শুধু আমাদের শারীরিক ক্ষতি করে না, এটি পরিবেশের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। গাছপালা নষ্ট হয়, প্রাণীদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়, এমনকি আবহাওয়ার পরিবর্তনও হয়। তাই আমাদের সবারই বায়ু দূষণ সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আজকের এই লেখায় আমরা বায়ু দূষণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, এর কারণগুলো খুঁজে বের করব এবং কীভাবে আমরা এ থেকে বাঁচতে পারি, তা নিয়েও কথা বলব।

বায়ু দূষণ কি?

বায়ু দূষণ হলো এমন একটি অবস্থা, যখন বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাস, ধূলিকণা বা রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায় এবং এটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করে। এই দূষিত বায়ু শ্বাস নেওয়ার ফলে আমাদের শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, বায়ু দূষণ বর্তমানে সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকির একটি কারণ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়, কারণ সেখানে যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার গ্যাস ও ধূলিকণা অনেক বেশি থাকে।

বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে বায়ু দূষণের হার সবচেয়ে বেশি। শীতকালে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়, কারণ তখন বাতাসের গতি কম থাকায় ধূলিকণা ও দূষিত গ্যাসগুলো বাতাসে স্থির হয়ে থাকে।

বায়ু দূষণের কারণে শুধু মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না, এটি জলবায়ু পরিবর্তনেরও অন্যতম কারণ। দূষিত গ্যাস ও ধোঁয়া ওজোন স্তরের ক্ষতি করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। ফলে বরফ গলে যায়, সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।

এইসব কারণেই আমাদের বায়ু দূষণ সম্পর্কে জানা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তাহলে চলুন, এবার জেনে নিই বায়ু দূষণের প্রধান কারণগুলো।

বায়ু দূষণের ১০টি কারণ

বায়ু দূষণের অনেক কারণ রয়েছে, তবে আমরা এখানে ১০টি প্রধান কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। বাংলাদেশে যেহেতু শিল্প ও নগরায়নের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই আমাদের এই কারণগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা দরকার।

১. যানবাহনের ধোঁয়া

বাংলাদেশের শহরগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে, যা বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে পুরনো ডিজেলচালিত যানবাহনগুলো প্রচুর পরিমাণে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড নির্গত করে, যা বায়ুর বিশুদ্ধতা নষ্ট করে।

ঢাকার মতো শহরে যানজটের কারণে যানবাহনগুলো অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে, ফলে দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি অযথা হর্ন বাজানোর ফলে শব্দ দূষণের পাশাপাশি বাতাসে ক্ষতিকর কণা ছড়িয়ে পড়ে।

২. কলকারখানার গ্যাস

বাংলাদেশে শিল্পখাতের উন্নতির কারণে অনেক নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে। কিন্তু বেশিরভাগ কারখানায় বর্জ্য ও গ্যাস নিঃসরণের নিয়ম মানা হয় না। ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মিশে যায় এবং পরিবেশের ক্ষতি করে।

বেশিরভাগ কারখানা অপরিশোধিত ধোঁয়া নির্গত করে, যেখানে থাকে সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস। এই গ্যাসগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে।

৩. নির্মাণ কাজের ধুলাবালি

নগরায়নের ফলে প্রতিদিন অসংখ্য নির্মাণ কাজ চলছে, যা থেকে প্রচুর ধুলাবালি বাতাসে মিশে যায়। ইট, বালু, সিমেন্টের কণা বাতাসের সঙ্গে মিশে ফুসফুসে প্রবেশ করলে নানা ধরনের শ্বাসজনিত রোগ হতে পারে।

বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এই ধুলাবালির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়, কারণ তখন বৃষ্টিপাত কম হয় এবং বাতাসে ধুলা বেশি সময় ধরে থাকে।

৪. কৃষি কাজ ও খড় পোড়ানো

গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা অনেক সময় ফসল কাটার পর খড়, পাতা ও অন্যান্য জৈব পদার্থ পোড়ায়, যা প্রচুর ধোঁয়া তৈরি করে এবং বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস ছড়িয়ে দেয়।

এছাড়াও, কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বাতাসে বিষাক্ত কণা মিশে যায়, যা দূষণের মাত্রা বাড়ায়।

৫. বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, গ্যাস ও ডিজেলের ব্যবহার করা হয়, যা প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ ঘটায়। এই গ্যাস ও ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

৬. আবর্জনা পোড়ানো

বিভিন্ন শহরে মানুষ রাস্তার পাশে বা খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ায়, যা প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া তৈরি করে। প্লাস্টিক ও রাসায়নিক পদার্থ পোড়ালে বায়ুতে বিষাক্ত গ্যাস মিশে যায়, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

৭. ধূপকাঠি ও গৃহস্থালি চুলার ধোঁয়া

গ্রাম ও শহরের অনেক বাড়িতে এখনো কাঠ বা কয়লার চুলা ব্যবহার করা হয়, যা প্রচুর ধোঁয়া তৈরি করে। এছাড়া, ধূপকাঠি ও মশার কয়েল পোড়ানোর ফলে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস মিশে যায়।

৮. বায়ুমণ্ডলের প্রাকৃতিক পরিবর্তন

কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন দাবানল, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ধুলিঝড়ের কারণে বায়ু দূষণ বেড়ে যায়। যদিও এটি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তবে এটি বায়ুর মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

৯. অপ্রতুল সবুজায়ন

গাছপালা বাতাসকে বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু বাংলাদেশে বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে গাছের সংখ্যা কমছে, যার ফলে বাতাসে দূষিত পদার্থের পরিমাণ বাড়ছে।

১০. ধুলোর ঝড় ও আবহাওয়ার পরিবর্তন

শুকনো মৌসুমে ধুলার ঝড় বায়ু দূষণকে বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে যখন বাতাসের গতি কম থাকে, তখন এই দূষিত কণাগুলো বাতাসে অনেকক্ষণ ভেসে থাকে এবং মানুষের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“বায়ু দূষণের ১০টি কারণ” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ কী?

যানবাহনের ধোঁয়া, কলকারখানার গ্যাস ও নির্মাণ কাজের ধুলাবালি বাংলাদেশে বায়ু দূষণের প্রধান কারণ।

বায়ু দূষণ প্রতিরোধের সহজ উপায় কী?

গাছ লাগানো, কম ধোঁয়া উৎপন্নকারী জ্বালানি ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।

উপসংহার

বায়ু দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। আমাদের উচিত ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে দূষণ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। গাছ লাগানো, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগে উদ্যোগী হতে হবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *