শিশু অধিকার গুলো কি কি?
শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা বড় হয়ে সমাজ, দেশ ও পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু, শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তাদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, অজ্ঞতা এবং আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে শিশুদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বাংলাদেশেও শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অপুষ্টি এবং শিক্ষার অভাব দেখা যায়। এই কারণে শিশু অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়া এবং তা সুরক্ষিত করা অত্যন্ত জরুরি।
এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো শিশু অধিকার কী, বাংলাদেশের শিশুদের অধিকারগুলো কী কী, এবং কীভাবে আমরা শিশুদের সুরক্ষিত করতে পারি। আশা করি, এই লেখাটি পড়ার পর আপনিও শিশুদের অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হবেন এবং তাদের সুরক্ষার জন্য ভূমিকা রাখতে উৎসাহী হবেন।
শিশু অধিকার কি?
শিশু অধিকার হলো এমন কিছু মৌলিক অধিকার, যা প্রতিটি শিশুর জন্মগতভাবে প্রাপ্য। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (UNCRC) ১৯৮৯ সালে শিশুদের জন্য একটি নির্দিষ্ট অধিকার তালিকা তৈরি করেছে, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশও ১৯৯০ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় বিভিন্ন আইন ও নীতি গ্রহণ করেছে।
শিশুর অধিকার মানে শুধুমাত্র খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নয়, বরং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বিনোদন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্যাতন থেকে সুরক্ষার মতো বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত। শিশুদের অধিকার রক্ষা করা মানে হলো, তাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই শিশুদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা অল্প বয়সেই শ্রমে যুক্ত হয়, তারা পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না, অনেকে স্কুলে যেতে পারে না, আবার কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হয়। এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে সরকার, পরিবার, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
শিশু অধিকার গুলো কি কি?
শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট অনেক অধিকার রয়েছে, যা তাদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশু অধিকারগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করি।
১. বেঁচে থাকার অধিকার
প্রতিটি শিশুর জন্ম থেকে সুস্থ ও নিরাপদভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় না বা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য, সচেতনতার অভাব, এবং চিকিৎসা সুবিধার সীমাবদ্ধতার কারণে শিশুমৃত্যুর হার এখনও অনেক বেশি।
শিশুর জন্মের পর থেকে তাকে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার, নিরাপদ আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন নবজাতকের মৃত্যু হার কমাতে টিকা কার্যক্রম, পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে এবং শিশুদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. শিক্ষা পাওয়ার অধিকার
প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার আগের তুলনায় বেড়েছে, তবে এখনও অনেক শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুরা আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নেমে যায়।
সরকার বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে এবং বিনামূল্যে বই ও উপবৃত্তি দিচ্ছে। তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই হবে না, শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে, যাতে শিশুরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।
৩. খাদ্য ও পুষ্টি অধিকার
পুষ্টিকর খাবার শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য জরুরি। কিন্তু অনেক শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা।
বাংলাদেশ সরকার স্কুলে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি ও বিভিন্ন পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। পরিবারগুলোকে আরও সচেতন হতে হবে, যাতে শিশুরা নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পায়।
৪. নির্যাতন থেকে সুরক্ষার অধিকার
শিশুরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অভিভাবক ও সমাজের দায়িত্ব।
শিশু নির্যাতন রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ হয় না। তাই শিশুদের প্রতি সদয় হতে হবে এবং কোনো শিশুর নির্যাতনের শিকার হলে প্রশাসনকে জানাতে হবে।
৫. শিশুশ্রম থেকে মুক্ত থাকার অধিকার
বাংলাদেশে অনেক শিশু তাদের বয়সের তুলনায় ভারী শ্রমে যুক্ত হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়। শিশুশ্রম বন্ধ করতে সরকার আইন প্রণয়ন করেছে, তবে দরিদ্র পরিবারের জন্য আরও সহায়তা দরকার।
৬. খেলার ও বিনোদনের অধিকার
শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শহরাঞ্চলে খেলার জায়গার অভাব এবং গ্রামাঞ্চলে অভিভাবকদের অনীহায় অনেক শিশু খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হয়।
৭. মত প্রকাশের অধিকার
শিশুরাও তাদের মত প্রকাশ করতে পারে, তবে আমাদের সমাজে তাদের কথা ততটা গুরুত্ব পায় না। পরিবার ও সমাজে শিশুদের কথা শুনতে হবে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
৮. পরিচয় ও জাতীয়তার অধিকার
প্রতিটি শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা জরুরি, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে পারে। অনেক দরিদ্র পরিবার এখনো তাদের সন্তানদের জন্ম নিবন্ধন করে না, যা পরবর্তীতে সমস্যা তৈরি করে।
৯. আশ্রয়ের অধিকার
প্রতিটি শিশুর একটি নিরাপদ বাড়ি প্রয়োজন। এতিম বা পথশিশুরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য আরও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা দরকার।
১০. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অধিকার
প্রতিবন্ধী শিশুদেরও সমান সুযোগ পাওয়া উচিত। তাদের জন্য বিশেষ স্কুল, চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“শিশু অধিকার গুলো কি কি?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
বাংলাদেশে শিশুদের সবচেয়ে বেশি কোন অধিকারের লঙ্ঘন হয়?
বাংলাদেশে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে, যা শিশুদের অধিকারকে লঙ্ঘন করে।
কীভাবে আমরা শিশু অধিকার রক্ষা করতে পারি?
শিশুদের প্রতি সদয় হওয়া, শিক্ষা নিশ্চিত করা, নির্যাতন রোধ করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই আমরা শিশু অধিকার রক্ষা করতে পারবো।
উপসংহার
শিশুদের অধিকার রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। সরকার, সমাজ ও পরিবার মিলে যদি সচেতন হয়, তবে শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময়, তাদের বিকাশের পথ সুগম করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।