মুসলিম ফুটবলারের তালিকা
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আজকে আমরা এমন একটা বিষয়ে কথা বলবো যেটা আমাদের অনেকের পছন্দের – সেটা হলো “ফুটবল” আর তার সঙ্গে জড়িত “ফুটবলার” বিষয়টি। বিশেষ করে আমরা বাংলাদেশিরা ক্রিকেটের পাশাপাশি এখন ফুটবলেও আগ্রহী হয়ে উঠেছি। অনেকে ফুটবলার হতে চায়, অনেকে আবার প্রিয় ফুটবলারের খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়। তবে, আজকের এই লেখাটায় আমি শুধু ফুটবলার কী তা-ই বলবো না, বরং আপনাদের জানাবো বিশ্বজুড়ে মুসলিম ফুটবলারের তালিকা এবং তাদের কৃতিত্ব সম্পর্কে। যারা ইসলাম ধর্ম পালন করেও বিশ্ব ফুটবলে দারুণ অবদান রেখেছেন। চলুন তাহলে শুরু করি।
ফুটবলার কি?
ফুটবলার হলো সেই ব্যক্তি, যিনি পেশাদারভাবে ফুটবল খেলে থাকেন। ফুটবল একটি দলগত খেলা, যেখানে প্রতিটি দল ১১ জন খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত হয়। খেলোয়াড়রা বল নিয়ন্ত্রণ করে গোল দেওয়ার চেষ্টা করে, আর প্রতিপক্ষকে গোল করতে বাধা দেয়। একজন ফুটবলারের শরীরচর্চা, ফিটনেস, কৌশল, ধৈর্য এবং দলগত মনোভাব থাকা খুব জরুরি। তাদের প্রতিদিন অনুশীলন করতে হয় এবং নিজের দক্ষতা আরও বাড়াতে হয়।
ফুটবলাররা সাধারণত ক্লাব এবং দেশের হয়ে খেলে থাকেন। ক্লাবগুলো বিভিন্ন লীগে অংশ নেয়, আর জাতীয় দলগুলো বিশ্বকাপ, অলিম্পিক বা আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। একজন ভালো ফুটবলার শুধু খেলার জন্য নয়, চরিত্র এবং শৃঙ্খলার দিক দিয়েও অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন।
ফুটবলাররা সমাজে বড় ভূমিকা রাখেন। তারা মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন, খেলার মাধ্যমে আনন্দ দেন, আর অনেক সময় দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে বিশ্বজয় করেন। ফুটবল এমন একটি খেলা যা শুধু খেলা নয়, এটা একটি আবেগ, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের মাধ্যম।
মুসলিম ফুটবলারের তালিকা
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মুসলিম ফুটবলার আছেন, যারা মাঠে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সারা দুনিয়ার মন জয় করেছেন। তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও আধুনিক ফুটবলের সব চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন। নিচে ১১ জন মুসলিম ফুটবলারের নাম এবং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
১. মোহাম্মদ সালাহ (Mohamed Salah)
মিশরের এই স্ট্রাইকার বর্তমানে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবে খেলেন। মোহাম্মদ সালাহ শুধু একজন দুর্দান্ত ফুটবলারই নন, তিনি একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবেও পরিচিত। মাঠে গোল করার পর তিনি সিজদাহ দিয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সালাহর ক্যারিয়ার শুরু হয় মিশরের ক্লাব এল মোকাওলউন থেকে, তারপর তিনি সুইজারল্যান্ডের বাসেল ক্লাবে যোগ দেন। পরে খেলেছেন চেলসি, ফিওরেন্টিনা, রোমা ও সর্বশেষ লিভারপুলে।
লিভারপুলে আসার পর সালাহ তার দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি শুধু মিশরের নয়, বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। ২০১7 সালে লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রিমিয়ার লিগে একাধিক রেকর্ড গড়েছেন। তিনি মুসলমানদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা, কারণ তিনি ইউরোপের মাটিতে ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। মানুষ তার কারণে ইসলামকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
২. করিম বেনজেমা (Karim Benzema)
ফ্রান্সের মুসলিম ফুটবলার করিম বেনজেমা দীর্ঘদিন ধরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন। তিনি মূলত একজন স্ট্রাইকার, যার গোল করার দক্ষতা অসাধারণ। বেনজেমা আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত এবং নিজের মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্বিত। তিনি রোজা রাখেন, নিয়মিত নামাজ পড়েন এবং নিজের জীবনধারায় ইসলামিক মূল্যবোধ বজায় রাখেন।
বেনজেমা রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে অসংখ্য ট্রফি জিতেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। ২০২২ সালে তিনি ব্যালন ডি’অর জয় করে বিশ্বকে চমকে দেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মিডিয়ার ঝাঁঝাল আলো থেকে দূরে থাকেন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন।
৩. পল পগবা (Paul Pogba)
ফ্রান্সের এই মিডফিল্ডার তার খেলার স্টাইল এবং ব্যক্তিত্বের জন্য অনেক জনপ্রিয়। পগবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ২০১৯ সালে এবং হজ্ব পালন করেও এসেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি শক্তিশালী, টেকনিক্যাল এবং বুদ্ধিদীপ্ত। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং জুভেন্টাসে তার ক্যারিয়ার অনেক সফল।
পগবা নিজের বিশ্বাস নিয়ে খুব সচেতন। তিনি প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামিক বার্তা শেয়ার করেন। তার হজ্ব যাত্রার ছবি এবং ভিডিও বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মধ্যে আনন্দ ও গর্বের অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। খেলাধুলার পাশাপাশি পগবা দান-খয়রাত এবং সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত আছেন।
৪. সাদিও মানে (Sadio Mané)
সেনেগালের এই তারকা খেলোয়াড় তার বিনয়, ধর্মীয় অনুশাসন এবং সমাজসেবার জন্য পরিচিত। তিনি লিভারপুলে খেলার সময় বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান। বর্তমানে তিনি সৌদি আরবের ক্লাব আল-নাসরে খেলছেন। মানে ইসলামী জীবনের অনুশাসন মেনে চলেন এবং নিজের গ্রামে মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি করে দারুণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
তিনি বলেছেন, “আমি বিলাসী জীবন চাই না। আমি চাই আমার দেশের মানুষ সুখে থাকুক।” সাদিও মানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন এবং খেলার পরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি প্রকৃত মুসলিম খেলোয়াড়ের দৃষ্টান্ত।
৫. এন’গোলো কান্তে (N’Golo Kanté)
ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী মিডফিল্ডার কান্তে তার সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং নম্রতার জন্য বিখ্যাত। তিনি ইসলাম ধর্ম পালন করেন এবং সব সময় ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেন। কান্তে বড় হয়েছেন দরিদ্র পরিবারে, কিন্তু নিজের পরিশ্রম দিয়ে আজ বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের তালিকায়।
কান্তে খেলাধুলার বাইরে খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন। তিনি বিলাসিতা পছন্দ করেন না এবং সব সময় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন। তার নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং বিনয়ী স্বভাব ফুটবল বিশ্বে একটি ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছে।
৬. রিয়াদ মাহরেজ (Riyad Mahrez)
আলজেরিয়ার এই উইঙ্গার বর্তমানে সৌদি আরবের আল-আহলি ক্লাবে খেলছেন। তিনি ম্যানচেস্টার সিটি ও লেস্টার সিটির হয়ে খেলেছেন এবং প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন। মাহরেজ মুসলিম হিসেবে নিজের পরিচয় নিয়ে গর্বিত এবং খেলাধুলার পাশাপাশি ইসলামের অনুসারী হিসেবে জীবনযাপন করেন।
তিনি নিয়মিত রোজা রাখেন, মসজিদে যান এবং খেলার মাঝে নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব ভুলে যান না। মাহরেজের খেলায় যেমন গতি ও কৌশল, তেমনি তার জীবনে রয়েছে ইসলামিক ভারসাম্য।
৭. মেসুত ওজিল (Mesut Özil)
জার্মানির এই মিডফিল্ডার তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ওজিল মাঠে নামার আগে দোয়া পড়েন, খেলায় শান্তস্বভাব থাকেন এবং সব সময় আল্লাহর স্মরণ করেন। তিনি আর্সেনাল ও রিয়াল মাদ্রিদে খেলেছেন এবং বর্তমানে খেলছেন তুরস্কের ক্লাব ফেনারবাহচেতে।
ওজিল সমাজসেবা, দান-খয়রাত ও মানবিক কাজের জন্য পরিচিত। তিনি প্রায়ই মুসলিম শিশুদের চিকিৎসা, শিক্ষা এবং খাদ্য সহায়তায় সাহায্য করেন। তার জীবনধারা একজন মুসলিম ফুটবলারের আদর্শ রূপ।
৮. হাকিম জিয়াচ (Hakim Ziyech)
মরক্কোর এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার চেলসি ও গ্যালাতাসারায় ক্লাবে খেলেছেন। তিনি মুসলিম এবং তার ধর্মবিশ্বাসকে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। খেলার পাশাপাশি তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে ভালোবাসেন।
জিয়াচ রোজা রাখেন, দান করেন এবং নিজেকে একজন দায়িত্বশীল মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার খেলার দক্ষতা ও ইসলামিক আচরণ বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করে।
৯. ইলকাই গুন্দোগান (İlkay Gündoğan)
জার্মানির এই মিডফিল্ডার তুর্কি বংশোদ্ভূত। তিনি ম্যানচেস্টার সিটি ও বার্সেলোনায় খেলেছেন। গুন্দোগান ইসলাম ধর্ম পালন করেন এবং খেলার মাঝে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন এবং ইসলাম সম্পর্কে সচেতন।
তার ব্যক্তিত্ব, নম্রতা এবং বিশ্বাস তাকে শুধু ফুটবল মাঠে নয়, মানুষের মনেও জায়গা করে দিয়েছে। গুন্দোগান দান-খয়রাত এবং সমাজসেবায়ও জড়িত।
১০. কালীদু কুলিবালি (Kalidou Koulibaly)
সেনেগালের এই ডিফেন্ডার ইতালির নাপোলি ও ইংল্যান্ডের চেলসিতে খেলেছেন। কুলিবালি ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং সব সময় ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রাখেন। তিনি রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন এবং খেলার আগে দোয়া করেন।
কুলিবালির সাহসিকতা, নেতৃত্বগুণ এবং বিশ্বাস তাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তুলেছে। মুসলিম হিসেবে তিনি তার পরিচয় গর্বের সঙ্গে বহন করেন।
১১. আমাদো হাইদারা (Amadou Haidara)
মালি’র এই মিডফিল্ডার বর্তমানে লাইপজিগ ক্লাবে খেলেন। তিনি তরুণ বয়সেই ফুটবল দুনিয়ায় নজর কাড়েন। হাইদারা একজন মুসলিম এবং ইসলামিক জীবনের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন।
তিনি রোজা রাখেন, খেলাধুলার সঙ্গে ধর্মের সমন্বয় বজায় রাখেন এবং ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। মাঠে তার প্রচেষ্টা, কৌশল এবং বিশ্বাস তাকে ভবিষ্যতের বড় তারকা করে তুলছে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“মুসলিম ফুটবলারের তালিকা” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
ফুটবলার হতে গেলে কী কী গুণ থাকা জরুরি?
পরিশ্রম, শারীরিক ফিটনেস, কৌশল, ধৈর্য ও দলগত মনোভাব – এই গুণগুলো একজন ভালো ফুটবলারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলিম ফুটবলাররা কি রোজা রেখে খেলে?
হ্যাঁ, অনেক মুসলিম ফুটবলার রোজা রেখেই খেলেন এবং তারা নিজের ধর্মীয় দায়িত্বও সুন্দরভাবে পালন করেন।
উপসংহার
এই লেখায় আমরা জানলাম ফুটবলার আসলে কী, তাদের জীবন কেমন এবং মুসলিম ফুটবলাররা কিভাবে বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। তারা শুধু মাঠেই নয়, জীবনেও ইসলাম ধর্মের আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছেন। এটা আমাদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা। আমাদেরও উচিত নিজেদের জীবনে নিয়মিততা, পরিশ্রম এবং নৈতিকতা বজায় রাখা। আপনি যদি ফুটবল পছন্দ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই এই ফুটবলারদের জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
ফুটবল শুধু খেলা নয় – এটা জীবন গড়ার একটা মাধ্যম হতে পারে। মুসলিম ফুটবলারদের জীবন সেই বার্তাই বহন করে।