১০ টি অমেরুদন্ডী প্রাণীর নাম

তুমি কখনও ভেবেছো, সব প্রাণীর কি হাড় থাকে? আমরা মানুষ, বিড়াল, কুকুর, এমনকি মাছও—সবাইয়ের শরীরে হাড় আছে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাণী আছে, যাদের শরীরে একটাও হাড় নেই। ভাবতে অবাক লাগছে? কিন্তু এটাই সত্যি! এসব প্রাণীকেই বলা হয় “অমেরুদন্ডী প্রাণী”।

আজকের এই লেখায় আমরা জানব, অমেরুদন্ডী প্রাণী আসলে কী, এরা কেমনভাবে বাঁচে, আমাদের পরিবেশে কীভাবে অবদান রাখে, আর বাংলাদেশের মতো একটি সুন্দর দেশের জন্য এদের গুরুত্ব কতটুকু। তার সঙ্গে থাকছে ১০টি পরিচিত অমেরুদন্ডী প্রাণীর নাম ও বিস্তারিত বর্ণনা। চলো, শুরু করা যাক!

অমেরুদন্ডী প্রাণী কি?

অমেরুদন্ডী প্রাণী হচ্ছে এমন প্রাণী যাদের শরীরে কঙ্কাল বা মেরুদন্ড নেই। সহজ করে বললে, এদের পিঠ বরাবর শক্ত কোনো হাড়ের কাঠামো নেই যেটা আমাদের আছে। মেরুদন্ড ছাড়া হলেও, এরা কিন্তু একেবারেই দুর্বল না। প্রকৃতিতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি—সব প্রাণীর প্রায় ৯৫%–ই অমেরুদন্ডী!

এরা হতে পারে ছোট ছোট পোকামাকড়, জেলিফিশ, কাঁকড়া, ঝিনুক থেকে শুরু করে বিশাল অক্টোপাস পর্যন্ত। এদের শরীর সাধারণত নরম হয়, তবে অনেকের দেহের বাইরের অংশ শক্ত আবরণে ঢাকা থাকে—যেমন গোঁফওয়ালা কাঁকড়া বা খোলসওয়ালা ঝিনুক।

অমেরুদন্ডী প্রাণীরা পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় বাস করে—জল, স্থল, আকাশ এমনকি মরুভূমি আর বরফের নিচেও! এদের খাদ্য, চলাফেরা, বংশবৃদ্ধি—সবকিছুতেই রয়েছে চমৎকার বৈচিত্র্য।

বাংলাদেশের নদী, খাল, বিল, হাওড়, বাওড়, সুন্দরবন থেকে শুরু করে শহরের ডাস্টবিন পর্যন্ত, সবখানেই এদের দেখা মেলে। এদের মধ্যে অনেকেই আমাদের জীবনে উপকার করে, আবার কেউ কেউ ক্ষতির কারণও হতে পারে।

তবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১০ টি অমেরুদন্ডী প্রাণীর নাম

এখন আমরা একটু বেশি কাছ থেকে চেনার চেষ্টা করব এমন ১০টি অমেরুদন্ডী প্রাণীকে, যাদের অনেকেই আমরা চিনি, আবার অনেকে সম্পর্কে জানি না খুব একটা। প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা গুণ, জীবনযাপন আর গুরুত্ব রয়েছে। চল, একে একে জেনে নেই।

১. পিঁপড়ে

পিঁপড়ে আমাদের সবার চেনা, ঘরের কোণে, দেয়ালে, বা খাবারের আশেপাশে এদের দেখা যায় প্রায়ই। ছোট্ট এই প্রাণীগুলোর কাজ কিন্তু বিশাল। এরা একসাথে দলবদ্ধভাবে বাস করে, এবং অসাধারণ শৃঙ্খলায় চলাফেরা করে। পিঁপড়েরা খুব পরিশ্রমী, তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই সংগ্রহ করে, বাসা বানায়, আর সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলে।

পিঁপড়ের শরীরে মেরুদন্ড নেই, তবে এদের শক্ত এক্সোস্কেলেটন (বাহ্যিক কঙ্কাল) আছে যা শরীরকে সুরক্ষা দেয়। এদের চোখ খুব সূক্ষ্ম, আর গন্ধ শুঁকে পথ চিনে চলে। পিঁপড়েরা সাধারণত মিষ্টি খাবারে আকৃষ্ট হয়।

এরা ফারোমন নামক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পিঁপড়ের সমাজে রয়েছে রানী পিঁপড়ে, কর্মী পিঁপড়ে, আর সৈনিক পিঁপড়ে। সবাই নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করে। পিঁপড়েরা পরিবেশে বর্জ্য পরিস্কার করে এবং মৃত প্রাণী খেয়ে মাটি উর্বর করে তোলে।

২. মৌমাছি

মৌমাছি শুধু মধু দেয় না, তারা পরিবেশের জন্যও খুব উপকারী। এরা গাছের ফুলে পরাগায়ন (pollination) ঘটায়, যার ফলে ফল, শাকসবজি জন্মায়।

মৌমাছিদেরও শরীরে মেরুদন্ড নেই, কিন্তু তাদের রয়েছে শক্ত ডানা, যা দিয়ে তারা উড়তে পারে ঘণ্টায় ২৪ কিমি বেগে। একটি মৌচাকে হাজার হাজার মৌমাছি থাকে—সবাই মিলে মধু সংগ্রহ করে, রাণী মৌমাছি ডিম পাড়ে, আর কর্মী মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনে জমায়।

মৌমাছিরা নিজেরা খাবার তৈরি করতে পারে, যেটা মধু নামে আমরা খাই। তাদের চোখ ও গন্ধ শোঁকার ক্ষমতা খুব তীক্ষ্ণ। পৃথিবীতে মৌমাছি না থাকলে, কৃষির অর্ধেক নষ্ট হয়ে যেত।

৩. জেলিফিশ

জেলিফিশ দেখলে মনে হয় যেন পানির ফোয়ারার মধ্যে নাচছে। এরা দেখতে জেলির মতো নরম, স্বচ্ছ আর রঙিন।

জেলিফিশের শরীরে হাড় তো নেই-ই, মাথা বা হৃদপিণ্ডও নেই! এরা শুধু স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে কাজ চালায়। তাদের শরীরের প্রায় ৯৮% জল, আর বাকি অংশে নরম টিস্যু থাকে।

এদের হাতের মতো লম্বা শুড় আছে, যেটা দিয়ে তারা শিকার ধরে। অনেক জেলিফিশ বিষাক্ত হয়, তাই সাবধান থাকা জরুরি। বাংলাদেশে গভীর সাগরে এদের দেখা যায়।

৪. কেঁচো

কেঁচোকে আমরা সাধারণত পাতার নিচে, মাটির ভেতর দেখি। মাটির জন্য এরা খুব উপকারী।

কেঁচো মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে চলে, আর সেই মাটি হালকা করে দেয়। এরা মৃত গাছপাতা খেয়ে মাটিকে উর্বর করে। এজন্য কেঁচোকে “কৃষকের বন্ধু” বলা হয়।

এদের কোনো চোখ নেই, কান নেই, কিন্তু ত্বকের মাধ্যমে সবকিছু অনুভব করে।

৫. অক্টোপাস

অক্টোপাস হলো সাগরের এক বিস্ময়কর প্রাণী। এদের আটটি বাহু থাকে, প্রতিটিতে শত শত ছোট ছোট চোষণির মতো অংশ থাকে।

এরা অনেক বুদ্ধিমান, শত্রুকে ফাঁকি দিতে কালি ছুঁড়ে দেয়। অক্টোপাস নিজের রং বদলাতে পারে, এমনকি নিজেদের বাহু কেটে ফেললেও আবার regenerate করতে পারে।

শরীরের মধ্যে কোনো হাড় নেই, তাই তারা যে কোনো সরু ফাঁকা দিয়ে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে।

৬. কাঁকড়া

কাঁকড়ার শক্ত খোলস থাকলেও তাদের মেরুদন্ড নেই।

এরা সাধারণত নদীর পাড়ে, সমুদ্রতটে কিংবা ঝোপে লুকিয়ে থাকে। কাঁকড়া হাঁটে পাশে পাশে, আর খাবারের জন্য ছোট ছোট পোকামাকড় বা মাছ খায়।

বাংলাদেশে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় অনেক প্রজাতির কাঁকড়া দেখা যায়, যাদের চাষও করা হয়।

৭. চিংড়ি

চিংড়ি মাছ না হলেও অনেকেই একে মাছ বলে ভুল করে।

এরা নদী ও সাগরে বসবাস করে, আর বিভিন্ন ধরণের অঙ্গ দিয়ে চলাফেরা করে। এদের গায়ে শক্ত খোলস থাকে, যা কিছুদিন পর পর বদলায়।

চিংড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে রপ্তানি খাতে।

৮. প্রজাপতি

প্রজাপতি মানেই রঙিন পাখা, হালকা ওড়াউড়ি আর ফুলের সঙ্গে খেলা।

প্রজাপতিরও মেরুদন্ড নেই। তারা ডিম থেকে শুঁয়োপোকা, তারপর গুটি, শেষে প্রজাপতি হয়ে জন্ম নেয়।

এরা ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে এবং পরিবেশে জীববৈচিত্র্য বজায় রাখে।

৯. মাকড়সা

মাকড়সা ঘরের কোণে জাল বুনে আর ছোট পোকামাকড় ধরে।

এদের ৮টি পা আর বিশেষ জাল তৈরির অঙ্গ থাকে।

মাকড়সারা খুব নিখুঁতভাবে জাল তৈরি করতে পারে, আর এদের জাল অনেক সময় অনেক পোকা ধরার কাজে আসে।

১০. ঝিনুক

ঝিনুক সাধারণত নদী বা সাগরের নিচে বাস করে। এরা দুই ফাঁকা খোলসের মধ্যে বাস করে।

ঝিনুকের শরীরে হাড় নেই, তবে শক্ত খোলসের মধ্যেই তাদের সব অঙ্গ কাজ করে। ঝিনুক ফিল্টার ফিডার, মানে তারা পানির মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র খাবার ছেঁকে খায়।

ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়া যায়, যা খুব মূল্যবান।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

“১০ টি অমেরুদন্ডী প্রাণীর নাম” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-

অমেরুদন্ডী প্রাণী কাকে বলে?

যেসব প্রাণীর শরীরে হাড় বা মেরুদন্ড থাকে না, তাদের অমেরুদন্ডী প্রাণী বলে। যেমন: পিঁপড়ে, মৌমাছি, কাঁকড়া ইত্যাদি।

অমেরুদন্ডী প্রাণী কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এরা পরিবেশ পরিষ্কার রাখে, পরাগায়ন ঘটায়, মাটি উর্বর করে এবং খাদ্যশৃঙ্খলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার

তো, বুঝতে পারলে তো? অমেরুদন্ডী প্রাণীরা ছোট হতে পারে, কিন্তু ওদের অবদান অনেক বড়। প্রকৃতির চক্র ঠিক রাখতে এরা নীরবে কাজ করে যায়। বাংলাদেশেও এসব প্রাণী আমাদের কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ—সবকিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আমরা যদি এদের গুরুত্ব না বুঝে নিধন করি, তাহলে প্রকৃতি আমাদেরও ছাড় দেবে না। তাই আসুন, অমেরুদন্ডী প্রাণীদের চিনি, বুঝি আর সংরক্ষণে সচেষ্ট হই।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *