পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য গুলো কি কি?
পৃথিবী এক আশ্চর্যের ভাণ্ডার। হাজার বছরের ইতিহাস, বিস্ময়কর স্থাপত্য, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য—সবকিছু মিলে পৃথিবী যেন এক রহস্যময় গ্রন্থ। তবে এই বিস্ময়ের মধ্যেও কিছু কিছু জিনিস এতটাই অনন্য ও চমকপ্রদ যে, মানুষ তাদের “সপ্তম আশ্চর্য” বলে অভিহিত করেছে। এই আশ্চর্যগুলো শুধু স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শনই নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানবজাতির অসাধারণ কীর্তির প্রতীক।
এই ব্লগে আমি তোমাদের সাথে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। কীভাবে এগুলো নির্বাচিত হয়েছে, কেন এগুলো এত জনপ্রিয়, এবং কীভাবে এগুলো পৃথিবীর ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে—এসব কিছু নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। তাহলে, চল শুরু করি এই রোমাঞ্চকর যাত্রা!
সপ্তম আশ্চর্য কি?
সপ্তম আশ্চর্য বলতে সাধারণত সেই সব বিস্ময়কর স্থাপত্য বা প্রকৃতির আশ্চর্যকে বোঝায়, যেগুলো মানুষ বা প্রকৃতির হাতে তৈরি হয়েছে এবং যেগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রাচীনকালে, গ্রিক ঐতিহাসিক ও পর্যটকেরা “প্রাচীন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য” নামে কিছু স্থাপনার তালিকা করেছিলেন। তবে সময়ের সাথে সাথে সেই তালিকার অনেক স্থাপত্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই ২০০৭ সালে “নতুন সপ্তম আশ্চর্য” নির্ধারণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ভোট আয়োজন করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এই ভোটিংয়ে অংশগ্রহণ করে এবং নতুন করে সাতটি বিস্ময়কর স্থাপনা নির্বাচন করা হয়।
এই আশ্চর্যগুলো শুধুমাত্র স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শনই নয়, বরং একেকটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। কিছু আশ্চর্য হাজার বছরের পুরোনো, আবার কিছু তুলনামূলক নতুন, কিন্তু প্রত্যেকটিই মানুষের সৃজনশীলতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
এই তালিকার প্রতিটি স্থাপনা এক একটি গল্প বলে—সম্রাটের প্রেমের কাহিনি, হারানো সভ্যতার নিদর্শন, প্রকৃতির ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের জয়। তাহলে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যগুলো সম্পর্কে বিশদভাবে জানার জন্য চল এগিয়ে যাই।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য গুলো কি কি?
পৃথিবীর নতুন সপ্তম আশ্চর্য নির্ধারণের জন্য ২০০৭ সালে এক আন্তর্জাতিক জরিপ চালানো হয়, যেখানে লাখো মানুষ তাদের মতামত দেন। এই ভোটের ভিত্তিতে সাতটি অসাধারণ স্থাপনা নির্বাচিত হয়, যা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। তবে আমি আজ তোমাদের জন্য আরও তিনটি অতিরিক্ত আশ্চর্যের কথা বলবো, যা আমার মতে পৃথিবীর আশ্চর্যের তালিকায় থাকা উচিত ছিল।
১. চীনের মহাপ্রাচীর
চীনের মহাপ্রাচীর পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ প্রতিরক্ষা প্রাচীর, যা প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি নির্মাণ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে এবং বিভিন্ন রাজবংশ এটি সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণ করেছে।
এটি তৈরি করা হয়েছিল শত্রুদের আক্রমণ থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য। মহাপ্রাচীরের প্রতিটি ইঞ্চিতে রয়েছে ইতিহাসের গভীর ছাপ। এটি শুধু প্রতিরক্ষা প্রাচীরই ছিল না, বরং বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথও ছিল।
আজ এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মহাপ্রাচীরের বিভিন্ন অংশে গেলে বোঝা যায়, কীভাবে মানুষ এত কঠিন ভূখণ্ডের মধ্যে এত বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করেছিল।
২. পেত্রা, জর্ডান
পেত্রা হলো জর্ডানের এক প্রাচীন শহর, যা একসময় নাবাতীয়দের রাজধানী ছিল। এটি লাল পাথরে খোদাই করা অসাধারণ স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত।
পেত্রাকে বলা হয় “রোজ সিটি” কারণ সূর্যের আলো যখন এর পাথরের গায়ে পড়ে, তখন এটি গোলাপি-কমলা রঙের হয়ে ওঠে। শহরটি ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্র, যেখানে প্রাচীনকালে আরব, গ্রীক, রোমান ও মিশরীয়দের বাণিজ্যিক পথ মিলিত হতো।
আজ এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। পর্যটকরা এখানে এসে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখতে পারেন, যা হাজার বছর আগের জীবনধারার সাক্ষ্য বহন করে।
৩. ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার, ব্রাজিল
এই বিশাল যিশুখ্রিস্টের মূর্তিটি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে অবস্থিত। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি।
১৯৩১ সালে নির্মিত এই মূর্তিটি ৩০ মিটার উচ্চতার এবং এটি কংক্রিট ও সাবান পাথর দিয়ে তৈরি। মূর্তিটি দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, যা শান্তি ও প্রেমের প্রতীক।
ব্রাজিলের মানুষের জন্য এটি শুধু ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং তাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।
৪. মাচু পিচু, পেরু
মাচু পিচু ইনকা সভ্যতার এক বিস্ময়কর নিদর্শন, যা আন্দিজ পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত। এটি ১৫ শতকে নির্মিত হলেও অনেক বছর পর্যন্ত এটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।
১৯১১ সালে হিরাম বিঙ্গহাম নামে এক গবেষক এটি আবিষ্কার করেন। মাচু পিচুতে বিশাল পাথরের তৈরি ভবন, মন্দির, জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে, যা ইনকা সভ্যতার উন্নত প্রকৌশল জ্ঞানের প্রমাণ দেয়। আজ এটি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য, যেখানে গিয়ে মানুষ প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখতে পারে।
৫. চিচেন ইৎজা, মেক্সিকো
মায়া সভ্যতার একটি অনন্য নিদর্শন হলো চিচেন ইৎজা। এটি মেক্সিকোতে অবস্থিত এবং ৯০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। এর প্রধান আকর্ষণ হলো কুকুলকান মন্দির, যা একটি বিশাল পিরামিড আকৃতির স্থাপনা। বিশেষভাবে নির্মিত এই মন্দিরে বছরে দুবার সূর্যের আলো এমনভাবে পড়ে যে, মনে হয় একটি সাপ ধাপে ধাপে নিচে নামছে। চিচেন ইৎজা ছিল মায়া সভ্যতার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
৬. রোমের কলোসিয়াম, ইতালি
এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাচীন অ্যাম্ফিথিয়েটার, যা রোমান সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত হয়েছিল। কলোসিয়াম ৫০,০০০ দর্শক ধারণ করতে পারত এবং এখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হতো। আজ এটি ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য একটি বিশাল আকর্ষণ, যেখানে গিয়ে মানুষ প্রাচীন রোমের কাহিনি জানতে পারে।
৭. তাজমহল, ভারত
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধ নির্মাণ করেন। তাজমহল শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্থাপনা, যা প্রেমের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য গুলো কি কি?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য কে নির্বাচিত করে?
২০০৭ সালে “New7Wonders Foundation” বিশ্বব্যাপী ভোটের মাধ্যমে নতুন সপ্তম আশ্চর্য নির্বাচন করে।
সপ্তম আশ্চর্যগুলো কি পরিবর্তন হতে পারে?
হ্যাঁ, ভবিষ্যতে নতুন জরিপের মাধ্যমে নতুন সপ্তম আশ্চর্য নির্বাচন করা যেতে পারে।
উপসংহার
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য শুধু স্থাপত্য নয়, বরং একেকটি সভ্যতার কীর্তি। এগুলো আমাদের অতীতের গল্প বলে, ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। তোমাদের যদি কখনো সুযোগ হয়, তাহলে অন্তত একবার এই আশ্চর্য স্থানগুলো ঘুরে আসার চেষ্টা করবে!