গর্ভাবস্থায় কি কি ফল খাওয়া যাবে না?
গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল একটি সময়। এই সময়ে একজন নারীকে তার নিজের ও তার অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হয়। গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কিছু কিছু খাবার এড়িয়ে চলাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় আমরা না জেনেই এমন কিছু খাবার খেয়ে ফেলি, যা গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে ফলের ক্ষেত্রে কিছু ফল আছে যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী, আবার কিছু ফল আছে যা এই সময়ে এড়িয়ে চলা ভালো। আজ আমরা জানবো গর্ভাবস্থায় কোন কোন ফল খাওয়া উচিত নয় এবং কেন তা পরিহার করা উচিত।
গর্ভধারণ কি?
গর্ভধারণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে নারীর শরীরে ভ্রূণ বেড়ে ওঠে এবং এক নির্দিষ্ট সময় পর এটি একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয়। সাধারণত, নারীর ডিম্বাণুর সাথে পুরুষের শুক্রাণুর মিলনের ফলে গর্ভধারণ ঘটে। গর্ভধারণের পুরো সময়কাল গড়ে প্রায় ৪০ সপ্তাহ বা ৯ মাস হয়ে থাকে। এই সময়টিতে মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় শরীরে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে, যেমন হরমোনের পরিবর্তন, ওজন বৃদ্ধি, মানসিক অবস্থা পরিবর্তন ইত্যাদি। এই সময়ে মায়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখা যেমন জরুরি, তেমনই গর্ভস্থ শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করাও অত্যাবশ্যক। তবে, কিছু কিছু খাবার এবং বিশেষ করে কিছু ফল গর্ভবতী নারীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এই সময়ে কোন কোন ফল এড়িয়ে চলতে হবে, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় কি কি ফল খাওয়া যাবে না?
গর্ভাবস্থায় এমন কিছু ফল রয়েছে যা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এগুলো গর্ভপাত, অকাল প্রসব কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। নিচে এমন কিছু ফলের তালিকা দেওয়া হলো, যা গর্ভাবস্থায় খাওয়া উচিত নয় এবং কেন তা এড়িয়ে চলতে হবে তা ব্যাখ্যা করা হলো।
১. পেঁপে
পেঁপে বিশেষ করে কাঁচা বা আধা-পাকা পেঁপে গর্ভবতী নারীদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। এটি গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। কারণ এতে প্যাপাইন এবং ল্যাটেক্স নামে দুটি উপাদান থাকে, যা জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে। জরায়ু সংকুচিত হলে গর্ভপাতের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
তবে, পুরোপুরি পাকা পেঁপে পরিমিত পরিমাণে খাওয়া নিরাপদ হতে পারে, কারণ এতে ফাইবার ও ভিটামিন রয়েছে, যা হজমে সহায়তা করে। তবুও, গর্ভবতী নারীদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পেঁপে খাওয়া।
২. আনারস
অনেকেই জানেন যে আনারস গর্ভাবস্থায় বিপজ্জনক হতে পারে। এতে ব্রোমেলিন নামে একটি এনজাইম রয়েছে, যা জরায়ুর সংকোচন ঘটিয়ে অকাল প্রসবের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশেষ করে, গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে আনারস খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলে এটি ডায়রিয়া বা এলার্জির কারণও হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় এই ফলটি এড়িয়ে চলাই ভালো।
৩. তরমুজ
তরমুজ শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে, তবে এটি গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে প্রচুর পানি থাকে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
তাছাড়া, কখনও কখনও তরমুজে ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে, যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গর্ভবতী নারীদের তরমুজ খাওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
৪. লিচু
লিচুতে উচ্চ পরিমাণে চিনি থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকলে লিচু একদম এড়িয়ে চলা উচিত।
এছাড়া, অতিরিক্ত লিচু খাওয়া হলে এটি গরম প্রকৃতির হওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় লিচু কম খাওয়াই ভালো।
৫. কলা (বিশেষ করে কাঁচা কলা)
অনেকেই মনে করেন কলা নিরাপদ, তবে কাঁচা কলা গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এতে থাকা ল্যাটেক্স এলার্জির সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।
যদি গর্ভবতী নারী ডায়াবেটিস বা ওজন বৃদ্ধির সমস্যায় ভুগে থাকেন, তবে অতিরিক্ত কলা খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
৬. আঙুর
আঙুরে রেসভারেট্রল নামে একটি যৌগ থাকে, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে গাঢ় কালো আঙুর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়া, আঙুরের খোসায় থাকা কীটনাশক বা রাসায়নিক পদার্থ গর্ভস্থ শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় আঙুর খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা জরুরি।
৭. কাস্টার্ড অ্যাপল (আতা ফল)
এই ফলটি অতিরিক্ত খেলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ। এটি কখনও কখনও ডায়রিয়া বা অ্যালার্জির সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।
৮. খেজুর
খেজুর পুষ্টিকর, তবে এটি শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায়। গর্ভাবস্থায় এটি জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে, যা অকাল প্রসবের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
৯. আমলকি
আমলকিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে এবং গর্ভাবস্থায় কিছু নারীর ক্ষেত্রে ডায়রিয়া বা গ্যাসের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
১০. স্ট্রবেরি
স্ট্রবেরিতে উচ্চমাত্রায় চিনি ও কিছু অ্যালার্জেন থাকে, যা গর্ভবতী নারীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“গর্ভাবস্থায় কি কি ফল খাওয়া যাবে না?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
গর্ভাবস্থায় কীভাবে সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়?
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত পানি ও ভিটামিনযুক্ত খাবার খেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?
রাসায়নিকমুক্ত ও তাজা ফল বেছে নিতে হবে এবং যেসব ফল ক্ষতিকর হতে পারে, সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থায় সঠিক পুষ্টিকর খাবার খাওয়া যেমন জরুরি, তেমনই কিছু নির্দিষ্ট ফল এড়িয়ে চলাও প্রয়োজন। যেসব ফল গর্ভপাত, অকাল প্রসব বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলো না খাওয়াই ভালো। গর্ভবতী মায়েদের উচিত সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবার নির্বাচন করা, যাতে মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ থাকে।